চার ঘণ্টায় আড়াই লাখ টাকা অবৈধ আয়
সাকিবুল এজাজ || বিজনেস ইনসাইডার
ইনফোগ্রাফ: বিজনেসইনসাইডারবিডি
ঢাকা (১২ ফেব্রুয়ারি): দিনে মাত্র চার ঘণ্টায় আড়াই লাখ টাকা আয় করা হচ্ছে। এই আয়ের পুরোটাই অবৈধ। পুরো টাকাটা যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করা হয়। গণপরিবহন খাতে প্রতিদিন এই অবৈধ আয় এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ ব্যাপার।
নিয়ন্ত্রণকারী ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায় এমন ঘটনা ঘটলেও কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বরং জোর করে এই অবৈধ আয় ও হয়রানি নিয়ে যাত্রীরা দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজধানীর সদরঘাটের চিত্র এটি। প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী চার ঘন্টায় এই টাকা আদায় করে গণপরিবহনের চালক-হেলপাররা। এই সময় সবচেয়ে কম দূরত্বের গন্তব্য সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ১০ টাকার স্থলে আদায় করা হয় ১০০ টাকা। যা শতাংশের হিসেবে ৯০০ ভাগ বেশী।
সদরঘাট এলাকায় সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিনই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ অন্যান্য স্থান থেকে আসা লঞ্চগুলো সাধারণত ভোর সাড়ে তিনটার পর থেকে রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড়তে থাকে। সর্বশেষ সকাল ৬টা-সাড়ে পর্যন্ত এসব লঞ্চ এসে থাকে।
অন্যদিকে, এসব লঞ্চ যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাত তিনটার পর থেকেই সদরঘাট টার্মিনাল থেকে পুরাতন কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০টি বাস অপেক্ষা করে। এসব বাসের কোনটির আসন সংখ্যা ৩২টি, কোনটির ৩৯টি। প্রধান সড়কের উপর এলোপাতাড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বাসের আসন সংখ্যার পুরোটা যাত্রী উঠানোর পরও দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানো হয়।
এসব গণপরিবহনের মধ্যে রয়েছে ভিক্টর ক্লাসিক, আকাশ পরিবহন, তানজিল পরিবহন, বাহাদুর শাহ, বিহঙ্গ, আজমেরি। এছাড়া সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে নিয়মিত চলাচল করে না এমন বাসও সকালে এই এলাকায় দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে লাভলী পরিবহন, দোয়েল পরিবহন ও মোহনা পরিবহন। এগুলো মূলত ঢাকা-দোহার ও ঢাকা-নারায়নগজ্ঞ রুটে চলাচল করে।
একাধিক বাস চালক, হেলপার ও যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভোরে সদরঘাট থেকে যেকোন গন্তব্যে যাওয়া হোক না কেন নির্দিষ্ট ভাড়ার চাইতে অনেক বেশী ভাড়া আদায় করা হয়। সদরঘাট থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত যেকোন গন্তব্যে ভাড়া ১০০ টাকা। এমনকি একেবারেই স্বল্প দূরত্বেও একই ভাড়া আদায় করা হয়। একইভাবে সদরঘাট থেকে টঙ্গী-এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেকোন গন্তব্যের ভাড়াও ১০০টাকা। সদরঘাট-মালিবাগ-রামপুরা হয়ে টঙ্গি পর্যন্ত যেকোন গন্তব্যে ভাড়া আদায় করা হয় ১২০ টাকা। সদরঘাট থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত যেকোন গন্তব্যে যাত্রী প্রতি ভাড়া আদায় করা হয় সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা।
যাত্রী ও গন্তব্য হিসেব করে সবচেযে কম দূরত্ব সদরঘাট-গুলিস্তান। এই দূরত্বেও যাত্রী প্রতি বাস ভাড়া ১০টাকার স্থলে ১০০ টাকা আদায় করা হয়। প্রতিদিন ৭০টি বাসের গড়ে ৩৫াট আসন সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে অংক কষে দেখা যায় প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী চার ঘণ্টায় জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে আদায় করা হয় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। যদিও প্রকৃত আদায়ের চিত্র এর চেয়েও বেশি।
যাত্রীরা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, সদরঘাট থেকে ছাড়া বিভিন্ন রুটের সব বাসই জোর করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
একাধিক যাত্রী জানান, বাসের চালক ও হেলপাররা ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় অবৈধভাবে ভাড়া আদায় করে থাকেন। এখানকার পুলিশ বুথে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না।
ঢাকা-বরিশাল রুটে নিয়মিত যাত্রী ব্যবসায়ী হাবীব। ব্যবসার কাজে তিনি সপ্তাহে দুই তিনবার ঢাকা বরিশাল যাতায়াত করেন। তিনি জানান, টার্মিনাল থেকে ভীড়ের মধ্যে ভারী ব্যাগ বা অন্যান্য জিনিস নিয়ে হাঁটা কষ্টকর। এছাড়া সড়কের উপর এলোপাতাড়ি বাস রাখার কারণে হাঁটার মতো পরিস্থিতি থাকে না। অনেকে সঙ্গে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হেঁটে যেতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়েই বেশী ভাড়ায় যেতে হচ্ছে।
কেন নির্দিষ্ট ভাড়ার চাইতে অনেক বেশী ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, জানতে চাইলে আজমেরি পরিবহনের কন্ট্রাক্টর হাসান এই প্রতিবেদককে জানান, এখানে বাস দাঁড় করাতে হলে টাকা দিয়ে সিরিয়াল নিতে হয়। যেই গাড়ি যত বেশী টাকা দিয়ে সিরিয়াল নেয় তার বাস আগে থাকে। এই কারণে ভাড়াও বেশী আদায় করতে হয়।
সিরিয়াল কার কাছ থেকে নিতে হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, পুলিশের লোক, সিটি কর্পোরেশনের লোক, বিআইডাব্লিউটিএ-এর লোকজন থেকে সিরিয়াল নিতে হয়। সবাই টাকার ভাগ নেয়।
ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চালক শরীফ জানান, টার্মিনালের সামনের সাড়ির বাসগুলোর জন্য দিতে হয় ১১০০ টাকা, পিছনের দিকের বাস গুলোর জন্য দিতে হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। তিনি আরো জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে লোক আসে, ওরা একটা সিরিয়াল নাম্বার সহ রিসিট দেয়। আর সিরিয়াল পাওয়া যায় টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
মূলত এই চাঁদার টাকা পুষিয়ে নিতেই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশী ভাড়া আদায় করা হয় বলে জানান বিহঙ্গ পরিবহনের চালক আরাফাত।
যাত্রী পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদক সদরঘাট মোড়ে পুলিশ বুথে একজন সার্জেন্টের (যার নেমপ্লেট ছিলো না) কাছে ভাড়া বেশীর অভিযোগ করতে চাইলে তিনি সমাধান না দিয়ে উল্টো বলেন, বেশী ভাড়া তো ইংলিশ রোড পর্যন্ত হেঁটে যান, ওইদিকে ভাড়া কম।