মূল্যায়নের মাপকাঠি নির্ধারণ না করেই প্রস্তাব গ্রহণ বিপিসির
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার
ফাইল ছবি
ঢাকা (০৪ ডিসেম্বর): মূল্যায়নের মাপকাঠি নির্ধারন না করেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল নিমার্নে দুটি বিদেশী কোম্পানির কাছ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এমনকি এলপিজি টার্মিনাল নিমার্ণের জন্য প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কোন সমীক্ষাও করেনি বিপিসি।
মূল্যায়নের মাপকাঠি ও সম্ভাব্যতা যাচাই না করে জাপানি দুটি কোম্পানি থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিপিসি বা জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান।
নিমার্ণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে তলরীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি)-এর এই টার্মিনাল নিমার্নের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বিজনেসইনসাইডারবিডি’কে বলেন, মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনালে জাপানের দুটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে। আমরা তাদের প্রস্তাব নিয়েছি।
প্রস্তাব মূল্যায়ন কিভাবে করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাদেও প্রস্তাবগুলো পর্যলোচনা করছি। পরে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে নেবো। প্রস্তাব যাচাই বাছাইয়ে বা মূল্যায়নের মাপকাঠি কি জানতে চাইলৈ চেয়ারম্যান জানান, এটা আমরা শিগগির ঠিক করে নেব।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রির্সোসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম এ
প্রসঙ্গে বলেন, মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনাল একটি দীর্ঘমেয়াদের প্রকল্প। এই প্রকল্প নেওয়ার আগে অবশ্যই সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রস্তাব মূল্যায়নের মাপকাঠি নির্ধারন করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মানদন্ড
নির্ধারন ছাড়া ও কোন সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধরণের জটিলতা ও ঝুঁকি তৈরি করবে। এভাবে
দীর্ঘমেয়াদি কোন প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে না।
জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতাবাড়ীতে মোট তিনটি পৃথক টার্মিনাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এই তিন টার্মিনাল হচেছ কয়লা টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল ও এলপিজি টার্মিনাল।
জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ীতে এই টার্মিনালগুলো নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর জাপান সফরে গেলে জাপান সরকার এসব প্রকল্পে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে টার্মিনাল প্রকল্পগুলো জাপানি কোম্পানির বিনিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও নেয়।
এদিকে, টার্মিনালগুলো নিমার্নের দায়িত্ব সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় জ্বালানি বিভাগের অধীন রাষ্ট্রীয় তেল আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি)। এরই প্রেক্ষিতে গত মাসে জাপানী কোম্পানি মিতসুই এর নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেশ করে।
মিতসুই এ্যান্ড কোং লিমিটেডের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম বিল্ড-অন-অপারেট (বিওইউ) ভিত্তিতে এই এলপিজি টার্মিনাল গড়ে তুলবে বলে প্রস্তাব উল্লেখ করে। এই কনসোর্টিয়ামে যুক্ত করা হয় এস কে গ্যাস নামে একটি কোরিয়ান কোম্পানিকে, যারা খুব বড় গ্যাস ক্যারিয়ারের মালিক (ভিএলজিসি)। সেই সঙ্গে স্থানীয় পার্টনার হিসাবে যুক্ত হয় এই অঞ্চলের বৃহত্তম এলপিজি অপারেটর ইস্ট কোস্ট গ্রুপকে, যাদের বাংলাদেশে এলপিজিসহ ডাউন স্ট্রিম পেট্রোলিয়াম খাতে প্রায় ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
জানা গেছে, মিতসুই গ্রুপের সঙ্গে প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর জাপানের আরেকটি সংস্থা মারুবেণী কর্পোরেশন এই কাজে আগ্রহ দেখায়। তারা ভিটল নামে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা একটি প্রস্তাব পেশ করে। মারুবেণী বা তার সহযোগী ভিটল আন্তর্জাতিক বাজাওে এলপিজি সরবরাহ করলেও কখনও এ জাতীয় এলপিজির গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নিমার্ণ বা পরিচালনা করেনি। এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে এখন এই দুটি জাপানী সংস্থা এই প্রকল্পটি পেতে চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপিসির প্রথমে সম্ভাব্যতা যাচাই করার কাজ হাতে নেওয়া উচিত এবং এরপর একটি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া বা উদ্যোক্তা নির্বাচন নীতিমালা তৈরি করে এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দেওয়া উচিত। তারা বলেন, বিশদভাবে প্রাক-সম্ভাব্যতা এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা ছাড়া এ জাতীয় বৃহত্তম প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কোনভাবে ভালো কিছু হবে না। কারণ
এটি করা হলে তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
সূত্র জানায়, বিপিসি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর, মিতসুই বিপিসির কাছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য একটি প্রস্তাব জমা দেয়, যেখানে বিপিসির জন্য ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ ভবিষ্যৎ আমদানিকৃত এলপিজি কিনে নিবে এবং এলপিজি টার্মিনাল থেকে অপারেটর টার্মিনালে পণ্য পরিবহনের জন্য ৬টি নতুন জাহাজ কিনতে অতিরিক্ত ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জাইকা এ ধরনের একটি শর্ত যুক্ত করেছে।
জানা গেছে, অপর জাপানী সংস্থা মারুবেণী কর্পোরেশনও অনুরূপ ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। মারুবেণী ভিটল নামক যে সংস্থাকে অংশীদার হিসেবে সঙ্গে নিয়েছে তারা দুই তিন বছর ধরে বাংলাদেশে এলপিজি সরবরাহ করে আসছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা এ জাতীয় গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা তাদের নেই।