বাংলার ইতিহাস ও একজন জহির রায়হান
ডেস্ক রিপোর্ট || বিজনেস ইনসাইডার
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা (৩০ জানুয়ারি): একজন জহির রায়হান, সেলুলয়েডের ফিতায় যিনি এঁকেছিলেন বাংলার ছবি। যে ছবি স্বাধীনতার কথা বলে, যে ছবি জীবনের কথা বলে। যে ছবি মাটির কথা বলে। এভাবে তাঁর লেখনিতে, চিত্রায়নে বারে বারে লিপিবদ্ধ হয়েছে বাংলার ইতিহাস।
তাঁর স্টপ জেনোসাইড বা বার্থ অব আ নেশন যেন শুধু এক একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল। একাত্তরের বিভৎস চিত্র উঠে এসেছে ছবিগুলোতে। তাঁর আরেক ফাল্গুন-এ আমরা খুঁজে পেয়েছি একুশের দিনগুলোকে। আবার ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তপ্ত পালে হাওয়া লাগিয়েছিল তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’। একইভাবে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া ‘বেহুলা’ ছিল ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত শ্রেণিদ্বন্দ্বের আলোকে নির্মিত লোকচিত্র। এই চলচ্চিত্রই বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয় এক নতুন অভিনেতার, বাংলা পায় এক নায়ক রাজ, রাজ্জাক।
পরিচালক এ জে কারদারের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রাঙ্গনে পদার্পন করেন জহির রায়হান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি অবলম্বনে জাগো হুয়া সাভেরা হয়ে ওঠে তাঁর চলচ্চিত্র শেখার হাতেখড়ি। এরপর সহকারী হিসেবে নাম লেখান সালাউদ্দিনের যে নদী মরুপথ, এহতেশামের এ দেশ তোমার আমার ছবিতে।
এরপর শুরু হয় পরিচালনার পালা। ১৯৬১তে মুক্তি পায় প্রথম ছবি কখনো আসেনি। সেই থেকে শুরু। এটিসহ এক দশকের পথচলায় তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছেন ১০টি। অন্যগুলো হলো সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, সঙ্গম, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, একুশে ফেব্রুয়ারী, জীবন থেকে নেয়া ও লেট দেয়ার বি লাইট। শুধু পরিচালনা নয়, একটি নতুন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে ধরেছিলেন প্রযোজনার হাল। দুই ভাই, কুচবরণ কন্যা, জুলেখা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, সংসার ও মনের মতো বউ-এর মতো ছবিগুলো প্রযোজনা করেন তিনি। ফাইটার্স, ইনোসেন্ট মিলিয়নস প্রযোজনা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভৎসতা তুলে ধরেছিলেন পুরো বিশ্বে।
এভাবেই ক্ষণজন্মা এই কিংবদন্তী নিজের সৃষ্টি দিয়ে মিশে ছিলেন বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে। বলেছেন স্বাধীনতার কথা। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কলকাতার ‘পরিচয়’ নামের সাহিত্য পত্রিকায় জহির রায়হান বলেছিলেন-
“বাংলাদেশ এখন প্রতিটি বাঙালীর প্রাণ। বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। সেখানে তারা গড়ে তুলবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, সেখানে মানুষ প্রাণভরে হাসতে পারবে, সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। লড়ছে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে। লড়ছে, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনকে অর্জন করার জন্য। বাঙলার মানুষের এই মুক্তির লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অঞ্চলের মেহনতি মানুষকেও শোষণমুক্ত হবার প্রেরণা যোগাবে।” লেখার শিরোনাম ছিলো ‘পাকিস্তান থেকে বাঙলাদেশ’।
১৯৭২ এ দেশ স্বাধীনের পর নিখোঁজ হয়েছিলেন জহির রায়হান। বাঙ্গালী হারায় একজন কথাশিল্পী, আলোকচিত্রী, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা; সর্বোপরি একজন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে। তবে নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে তিঁনি বাঙ্গালীর হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন হাজার বছর ধরে ।