টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন
প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নগদ সহায়তা পেতে গড়ে ২২০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার
ছবি: ফাইল ফটো
ঢাকা (১০ নভেম্বর): করোনা ভাইরাসের কারণে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুই হাজার ৫০০ টাকার নগদ সহায়তা পেতে প্রত্যেক উপকারভোগীকে গড়ে ২২০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর নগদ সহায়তার তালিকাভুক্ত হতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে ১২ শতাংশ উপকারভোগী। মঙ্গলবার অনলাইনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলয়ায় চ্যালেঞ্জ: দ্বিতীয় পর্বের গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন। অনুষ্ঠানে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের মধ্যে নগদ অর্থ প্রণোদনার অনিয়মের বিষয়ে দেশের ৩৫টি জেলার এক হাজার ৫০জনের মধ্যে বক্তব্য নিয়েছে টিআইবি। ওএমএস কার্ডে অনিয়ম নিয়ে ৩২ জেলার ৯৬০ জনের মতামতও নিয়েছে টিআইবি। এ বছর ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত টিআইবি এ গবেষণা পরিচালনা করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে নগদ সহায়তা উপকারভোগীদের ১২ শতাংশ তালিকাভুক্ত হতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ জোগাড় করা (৩৬ দশমিক এক শতাংশ), অনেকবার অনুনয়-বিনয়/অনুরোধ করা (২৪ দশমিক ৬ শতাংশ), নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ বা ঘুষ দেওয়া (১৮ দশমকি ৯ শতাংশ), টাকা না পাওয়া (১০ দশমকি ৬ শতাংশ) ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। আর তালিকাভুক্ত হতে গড়ে ২২০ টাকা করে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ বা ঘুষ দিতে হয়েছে।
অন্যদিকে জরিপে কার্ডের মাধ্যমে বিশেষ ওএমএস চাল (১০ টাকা কেজি দরে) সহায়তায় উপকারভোগীদের ১০ শতাংশ তালিকাভুক্ত হতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ জোগাড় করা (৩৭ দশমিক এক শতাংশ), অনেকবার অনুনয়-বিনয়/অনুরোধ করা (২০ দশমিক ৬ শতাংশ), নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ বা ঘুষ দেওয়া (১৫দশমিক ৫ শতাংশ) ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
জরিপে নগদ সহায়তায় উপকারভোগীদের ৫৬ শতাংশ সহায়তা পেতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। এক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরনের মধ্যে তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও এখনো টাকা না পাওয়া (৬৯ দশমিক শূন্য শতাংশ), মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট কর্তৃক কমিশন/ফি কেটে রাখা (২৬ দশমকি ৬ শতাংশ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নগদ টাকা তুলতে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট কমিশন/ফি বাবদ গড়ে ৬৮ দশমিক ২০ টাকা করে কেটে রাখে।
এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়।
জরিপে দেখা গেছে, ওএমএস (চাল) সহায়তায় উপকারভোগীদের ১৫ দশমকি শূন্য শতাংশ চাল পেতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। এক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরনের মধ্যে ছিল, পরিমাণে কম দেওয়া (৩৬ দশমকি ৮ শতাংশ), তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও চাল কিনতে না পারা (২০ দশমকি ৬ শতাংশ), ওজন না করে বালতিতে অনুমান করে চাল দেওয়া (১৯ দশমকি ৯ শতাংশ) ইত্যাদি।
নগদ সহায়তা কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান/মেম্বার/কাউন্সিলর (৭৯ দশমকি ২ শতাংশ) ও স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা (৪৮ দশমকি ৭ শতাংশ)। বিশেষ ওএমএস (চাল) বিতরণ কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সংসদ সদস্য, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান/মেম্বার/কাউন্সিলর (৬৫ দশমকি ৭ শতাংশ) ও স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার (৪০ দশমকি ১ শতাংশ) সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানায় সুবিধাভোগীরা।
করোনাকালীন যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুনীতির প্রমাণ মিলেছে, তাদের ৯০ জনই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল। একটি প্রতিবেদন হতে জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সরাসরি ও হটলাইনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তারা প্রকৃত দুস্থদের বঞ্চিত করে করোনাকালে সরকারের দেওয়া ত্রাণ ও নগদ অর্থ সহায়তাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
করোনাকালীন মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে এ পর্যন্ত শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত করে। তবে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই (অন্তত ৩০ জন) উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমে স্বপদে ফিরে এসেছে। এর কারণ হিসেবে অনেকক্ষেত্রে আদালতে জোরালো ভাবে তথ্য উপস্থাপন না করা, সরকারপক্ষের আইনজীবীর আদালতে উপস্থিত না হওয়া, আসামিপক্ষ বা বরখাস্ত চেয়ারম্যানদের পক্ষের আইনজীবীদের জোরালোভাবে বরখাস্তের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তুলে ধরার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সরকারের বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করে রায় দেয়।