এক ডিসেম্বর,১৯৭১: কি ঘটে ছিলো সেদিন
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার
ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইন আর্কাইভ থেকে নেওয়া
ঢাকা (০১ ডিসেম্বর): আজ এক ডিসেম্বর। ৪৯ বছর আগে স্বাধীনতাকামী বাঙালীর তীব্র প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের আগে থেকেই শুরু হওয়া মুক্ত সংগ্রাম এই মাসে এসেই চূড়ান্ত রূপ নেয়। কিন্তু কি ঘটেছিলো সেদিন।
১৯৭১ সালের এক ডিসেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে ঢাকার জিঞ্জিরার অনেক যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী। নারী, শিশুরা পর্যন্ত তাদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি।’
এদিন বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে আড়ালে রাখতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে বেতারে ঘোষণা দেন। একইদিন ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে ঢাকায় দুজন মুসলিম লীগ কর্মীকে হত্যা করে। বাকি দুজনকে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদে বক্তৃতাকালে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া খানের প্রতি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানান।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা শেষরাতের দিকে সিলেটের শমসেরনগরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনী এই এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন অব্যাহত থাকায় পাকবাহিনী এই জেলার গারা, আলিরগাঁও, পিরিজপুর থেকে তাদের বাহিনী গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এ সময় রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিনস্তানের এক মুখপাত্র ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়নি’ বলে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
ঢাকা পিপলস পার্টির ঢাকা অফিস বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো দুমাস আগে এ অফিস উদ্বোধন করেন। রাঙ্গামাটিতে ব্যাপটিস্ট মিশনে পাকহানাদার বাহিনীর বর্বর হামলায় চার্লস আর. হাউজার নামে একজন ধর্মযাজক এবং বহু বাঙালি নিহত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘২ ডিসেম্বর আমার কাছে এই মর্মে একটি বার্তা পৌঁছে যে, সিলেট এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্ত-অঞ্চলে পাকা ধান কাটার অপেক্ষায় আছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী এই ধান অল্প দামে ক্রয় করে সীমান্তের ওপারে ভারতে চালান করছে। বিনিময়ে লবণ, কেরোসিন তেল ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছে। সংবাদটি পেয়েই আমি অর্থ ও বাণিজ্য সচিবকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। এখান থেকে মিত্রবাহিনীর সমস্ত অগ্রযাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হতো। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাহিনীর কোন্ ইউনিট কোথায় যুদ্ধরত, কোন্ কোন্ শহর দখল করছে, ইত্যাদি তথ্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনিটর করা হতো। প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ, সচিব নূরুল কাদের ও আমি ঘন ঘন গিয়ে খবর নিতাম। অনেক সময় গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরববর্তীতে বিমান বাহিনী প্রধান ও পরিকল্পনা মন্ত্রী) এ কে খন্দকার সাথে থাকতেন। এর মধ্যে প্রতিদিনই আমাদের একবার করে ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে হত। ওখানে বিশেষ স্থাপনাগুলো এবং গোপন অফিস সবই মাটির নিচে; বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না।