জ্ঞানীদের জ্ঞান উড়ে উড়ে যায়....
হাসান আজাদ || বিজনেস ইনসাইডার
গ্রাফিক্স বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ
গেল সপ্তাহের ঘটনা। রাজধানীর একটি শপিংমলে যেতে হয়েছে কিছু কেনাকাটার জন্য। ওই শপিংমলের নিচতলায় একটি পোশাকের দোকানে গিয়ে দেখি বিক্রেতা ছাড়া কোনো ক্রেতার মুখেই মাস্ক নেই। মাস্ক আছে, থুতনির নিচে অথবা তা ঝুলন্ত দোলনার মতো গলায় ঝুলছে। বিক্রেতা বেশ কয়েকবার ক্রেতাদের মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ করলেও অধিকাংশই অগ্রাহ্য করছেন। আর যারা এই কথায় বিরক্ত হয়েছেন, তারা বেরিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি।
পোশাকীতে বেশ ভদ্র ও শিক্ষিত-গোছের এক বিক্রেতার অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে না-পেরে বলেই ফেললেন, ‘মাস্ক পরতে হবে এটা আমিও জানি। আমাকে শিখাতে হবে? আমাকে দেখে কি মূর্খ মনে হয়?’ ক্রেতার যখন এমন বাক্যালাপ ও আচরণ করছিলেন, তখনো তার গলায় শোভা পাচ্ছিল ঝুলন্ত মাস্ক! বিক্রির আশায় আর কথা বাড়াননি বিক্রেতা। কিন্তু পণ্য-বিক্রি তো হলই না, উল্টো রাগান্বিত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক!
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এরইমধ্যে শুরু হয়েছে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ। তৃতীয় ঢেউয়ে ভাইরাসটির নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’চোখ রাঙাচ্ছে। লকডাউনসহ নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে ভারতের এই রাজ্যটিতে। সেখানে বাংলাদেশীদের আনাগোনা বেশি এবং নিকটবর্তী। এ ছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নতুন এই ধরনটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেন উল্টো হচ্ছে বাংলাদেশে! সরকার, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বার বার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের অনুরোধ বা আহ্বান করার পরেও তা আমাদের, মানে জনগণের কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না। অফিস আদালত, রাস্তা-ঘাটে মানুষের চলাচল দেখে মনে হয়, এ দেশ করোনাভাইরাস মুক্ত। দেশে গেল এক সপ্তাহ ধরে করোনায় আক্রান্তর হার ক্রমশ বেড়েছে, সামনেও বাড়বে বলেই সকলের ধারণা।
গেল কয়েকদিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মাস্ক না-পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি না-মানা। এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহন করা, রাত ৮টা পর্যন্ত শপিংমল খোলা রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হোটেলে কোভিড টিকা কার্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আর রাতেই ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আরও ভয়ংকর তথ্য হল, বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখনো মানুষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু ওমিক্রনের সংক্রমণ শক্তি বেশি হওয়ায় আরও বেশি সংখ্যক লোক আক্রান্ত হবে বলে তিনি ধারণা করছেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্তের শুরুটা আরও পরে হয়েছে। তারপরেও দেশের একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কিনা করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না। তারপরেও বিধি নিষেধ মানছে না। এই না মানার তালিকায় রয়েছে দেশের অগ্রসর অংশ বা জ্ঞানীরা। যারা সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এরমধ্যে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ অন্যতম। ইদানীং এই দুই শ্রেণির কাছেই করোনাভাইরাস মনে হচ্ছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।
গত মাসাধিককাল ধরে দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে। এসব নির্বাচনে রাজনীতিবিদরা অংশ নিচ্ছেন। আর তাদের সমর্থনে সমর্থকরা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও মারামারি-সংঘর্ষ হচ্ছে। মিছিল-মিটিং সবই হচ্ছে। হচ্ছে না কেবল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা। এমনকি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো নেতাকে বলতে শোনা যায়নি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বা মাস্ক পরে নির্বাচনী প্রচারণা করতে হবে। এসব নেতাদের কাছে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়েও যেন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন! সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থা একই।
মঙ্গলবার দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বাষির্কী গেল। এ উপলক্ষে মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও শীর্ষ নেতা থেকে শুরু কর্মী পর্যন্ত কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানেননি বরং ভয়াবহ এই রোগটিকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। কিন্তু এই ছাত্রলীগই করোনা মহামারির শুরুতে আক্রান্তদের সহযোগিতা করেছে।
এবার আসুন সুশীল সমাজের কথা। এই সমাজ সব-সময়ই অগ্রসর ও সামাজিক হিসেবে বিবেচিত। এই শ্রেণিটাও এখন আর আগের মতো করোনা নামক ভাইরাসকে আমলে নিচ্ছে না। মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। এই শ্রেণির গুটি-কয়েক ব্যক্তি ছাড়া বাকিরা অন্যদের মতোই। এই শ্রেণির মানুষদের থুতনি বা গলায় মাস্ক ঝুললেও মুখবন্ধনী হিসেবে ব্যবহারটা এখন অনেক কমে এসেছে।
তো এই অবস্থায় মানুষ কেন স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, রাজনীতিবিদ, সুশীলরা কেন মানছে না, এটা জানতে এবং বুঝতে একটি খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনস্তাত্ত্বিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তিনি যেতে বললেন, শর্ত দিলেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে উনার চেম্বারে নয়, বাইরে কথা বলতে হবে; রাজি হলাম। নির্দিষ্ট দিনে গেলাম। সাক্ষাৎ হল একটা বটতলায়। প্রশ্ন করলাম, অগ্রসর শ্রেণি বা রাজনীতিবিদরা জানার পরেও কেন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না? উত্তরে বললেন, এই শ্রেণি দুটো ‘জ্ঞানী ও অগ্রসর’। এঁরা জ্ঞান দেন। যে কারণে এই জ্ঞানীদের জ্ঞান উড়ে উড়ে যায়...।
১১ জানুয়ারি, ঢাকা।